Special ReportsPublished on Jun 01, 2024
ballistic missiles,Defense,Doctrine,North Korea,Nuclear,PLA,SLBM,Submarines

২০২৩ সালে বিশ্ব: একটি উপসংহার

বিশ্বব্যবস্থায় আর যা কিছু বাকি ছিল, সেই দিক থেকে দেখতে গেলে ২০২৩ সালটি কফিনে পোঁতা শেষ পেরেকের মতোই। বিশ্ব জুড়ে ইতিমধ্যেই অস্থিরতা অব্যাহত ছিল। কারণ একাধিক দ্বন্দ্ব বিশ্ব পরিবেশকে ক্রমাগত আকার দিয়েছে, প্রধান শক্তিগুলির মধ্যে বিভাজন তীব্রতর হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের দুর্বল ধারা অব্যাহত রেখেছে। উদীয়মান প্রযুক্তিগুলি আন্তর্জাতিক শক্তি ভারসাম্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভাজন ত্বরান্বিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে নেতৃত্বের অভাব বিশ্বের গণপণ্যের জন্য কার্যকর ভাবে প্রবিধান নির্মাণে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অক্ষমতাতেও অবদান রেখেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন রায়েল-হামাস দ্বন্দ্বের সঙ্গে সঙ্গে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের কেন্দ্রে যুদ্ধই এখন বিবেচ্য বিষয়। শক্তির উপকরণ এখন স্পষ্টতই সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ক্রমের নিরিখে একটি প্রধান অংশ এবং এর শক্তি এই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে,  আন্তর্জাতিক রাজনীতির নৈরাজ্যমূলক প্রকৃতি রাষ্ট্রগুলির আচরণের উপর চাপ প্রয়োগ করে চলেছে। প্রতিষ্ঠান, বাজার নিয়ম কোন অবকাশ মানে না; শক্তিশালী দেশগুলি নিজেদের ইচ্ছা মতো কাজ করতে থাকে এবং অন্য দিকে দুর্বল দেশগুলি এর ফল ভোগ করেনিউ নর্মাল বা নতুন স্বাভাবিক ব্যবস্থা সেই চিরাচরিত স্বাভাবিকীকরণেরই অন্য রূপ, যার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বিস্মৃত হয়েছে।

এই দ্বন্দ্বগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের মধ্যে শক্তি প্রতিযোগিতার তীক্ষ্ণতার সঙ্গে সমানুপাতী। ইন্দো-প্যাসিফিক এখনও প্রতিযোগিতার ভরকেন্দ্র এবং এই অঞ্চলে উত্তেজনা সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক অব্যবস্থা বা নৈরাজ্যের জন্য যে যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজন, তা একেবারেই অনুপস্থিত বিশ্ব তাই ২০২৪ সালে এই পূর্বাভাস দিয়ে শুরু করেছে যে, অতীতের অনুমানগুলি ভবিষ্যতের প্রবণতাগুলিকে সুনিশ্চিত করার জন্য আর যথেষ্ট নয়। 

হিংসার ছায়া সর্বদা আন্তঃরাষ্ট্রীয় মিথস্ক্রিয়াগুলির পরামিতিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। কঠোর শক্তির হিংস্রতা আন্তর্জাতিক বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ক্ষেত্রে কয়েকটি শক্তির আত্মতুষ্টিকেও প্রতিফলিত করে। চিন যখন পরাক্রমে শক্তি সঞ্চয় করেছিল, তখন ইউরোপের সামরিক কাঠামো ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য ইইউ-এর সংগ্রাম সম্মুখ সমর থেকে পিছিয়ে আসার প্রবণতাকেই দর্শায়। সর্বোপরি, মার্কিন প্রতিপক্ষরা যখন এক দিকে জোটবদ্ধ হচ্ছে, তখন মার্কিন সামরিক যন্ত্র একাধিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা কাজটিতে আরও বেশি পরিমাণে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।

এ কথা আশ্চর্যের নয় যে, বেশির ভাগ দেশই তাদের নিজেদের সামর্থ্যের উপর ভরসা করে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। ইন্দো-প্যাসিফিক সেই একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠেছে, যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনীতির ভরকেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়েছে। এই মঞ্চে সামরিক ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী নতুন কৌশলগত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ইইউ ক্ষমতার আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক ভারসাম্য গঠনে নিজস্ব অপ্রতুলতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি জার্মানি জাপান পরিবর্তিত সময়ের প্রমাণ হিসাবে তাদের সামরিক শক্তির ক্ষমতার উপর একক ভাবে মনোনিবেশ করার পাশাপাশি নিজেদের কৌশলগত পছন্দগুলির পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেছে।

ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব মনই এক সঙ্কটময় সময়ে ঘটেছে এবং ভারতকে একটি অস্থির বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্বে জায়গা করে নেওয়া ও নয়াদিল্লির বহুপাক্ষিকতার হয়ে সওয়াল করার সুযোগ করে দিয়েছে। ভারতের লক্ষ্য ছিল বিচ্যুত বৃহৎ শক্তিগুলিকে জি২০-র আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনা এবং এমনটা করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসাবে তার নিজস্ব অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করা।

ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের লক্ষ্য ছিল মেরুকরণ থেকে বিশ্বকে বৃহত্তর সংহতির অভিমুখে চালিত করা। একটি বহুসাংস্কৃতিক গণতন্ত্র হওয়ার নিজস্ব বাস্তবতা ভারতকে বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জগুলি বুঝতে এবং তা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বৈচিত্র্যময় অংশীদারদের একত্রিত করতে প্রস্তুত করেছে। ২০২৩ সালের জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের মূল ভাবনা ছিল বসুধৈব কুটুম্বকম: এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎএই মন্ত্রে ভারতের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা তার নিজস্ব ভূমিকা অন্তর্নিহিত হয়েছে।

নয়াদিল্লি দেখিয়েছে যে, ভারত কেবল বাগাড়ম্বরেই বিশ্বাসী নয়। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করা এবং ন্যূনতম সংস্থানের জন্য যুঝতে থাকা দেশগুলিকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিল। এমনটা ভারত করেছে সেই গুরুতর সময়ে, যখন উন্নত দেশগুলি তাদের মনোযোগ শুধু মাত্র নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল এবং অনেক দেশই প্রাপ্তবয়স্কদের পাঁচ বার করে দেওয়ার মতো টিকা ভবিষ্যতের জন্য মজুত করে রেখেছিল। গুরুতর বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের সময়ে নয়াদিল্লি কার্যকর ভাবে ভারতের কাছে উপলব্ধ সমস্ত সাধনী এবং মঞ্চগুলিকে একত্রিত করে সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করেছে অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশ সকলের কল্যাণের স্বার্থে সম্পৃক্ত হওয়ার বদলে এই সময়ে আরও বেশি করে শুধু মাত্র অন্তর্মুখী থেকেছে। এটি আসলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করার বিষয়ে ভারতের প্রচেষ্টাকে দর্শায়, যখন চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই তাদের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এনেছে। ভারত দেখিয়ে দিয়েছে যে, সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও সমমনস্ক দেশগুলির উদ্বেগের রূপরেখা নির্মাণ করে এবং ছোট দেশগুলিতে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সকলের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষমতা সে রাখে। ২০২৩ সালে শৃঙ্খলার বোধ তৈরি করার জন্য যখন গোটা বিশ্ব সংগ্রাম করছে, তখন একটি ইতিবাচক পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক ফলাফলগুলিকে আকার দিতে প্রস্তুত ভারতের মতো আর কোনও দেশ ছিল না।

এই নিবন্ধগুচ্ছটিতে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী পরিসরকে রূপদানকারী মূল প্রবণতাগুলির রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। বিগত বছরগুলির মতো এ বছরও গবেষকরা তাঁদের নিজ নিজ পরিসরে তিনটি করে মেটা প্রবণতা বর্ণনা করেছেন। প্রথম বিভাগটিতে বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলির উপর আলোকপাত করে দেখানো হয়েছে যে, কী ভাবে মূল বিশ্ব শক্তিগুলি দ্রুত বিকশিত অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন উভয়ই অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত এবং তারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার এক পথ সন্ধানের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইউরোপ যখন ইউক্রেন যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ক্লান্তির সম্মুখীন, তখন পুতিনের রাশিয়া অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা সামরিক পুনর্নির্মাণের সাহায্যে ইউক্রেনের অবস্থাকে সঙ্গিনতর করে তুলতে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

দ্বিতীয় বিভাগে প্রধান দেশগুলির নিরিখে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে পরিবর্তিত আঞ্চলিক গতিশীলতার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক যখন তীব্র নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মধ্যে অংশীদারিত্বের একটি উল্লেখযোগ্য সমন্বিতকরণকে দর্শিয়েছে, তখন মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার আশাবাদী প্রবণতা চিরাচরিত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সহিংস পুনরুত্থানের সম্মুখীন হয়েছে। লাতিন আমেরিকা অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক উদ্বেগ ভূ-রাজনীতিকে ছাপিয়ে যাওয়ার দরুন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলিকে মস্কোর অর্থনীতি সদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করেছে। বিশ্বশাসনে আফ্রিকার গুরুত্ব ও মূল্য হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন মহাদেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুঝছে। ইন্দো-প্যাসিফিকের যুগে ভারত ও চিনের আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলির উপর মনোনিবেশ করছে।

শেষ বিভাগে বিগত বছরের কিছু মূল আন্তুর্জাতিক ভাবনা ও সমস্যা বর্ণনা করা হয়েছে। নতুন প্রযুক্তি যুদ্ধের কার্যকর বাস্তবতাকে আকার দেয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিভাজন ও বৈষম্য বিরাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অপরিবর্তনীয় প্রভাব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় ভয়ানক সতর্কবার্তা দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক জলবায়ু কর্মসূচিকে পুনর্নিশ্চিত করা হয়েছে এবং জলবায়ু সঙ্কটের ফলে ক্ষয় ও ক্ষতি মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কপ২৮-এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড চালু করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রশাসন ক্রমাগত বিবর্তিত হতে থাকেকারণ বিবর্তনের জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগত সমাধান উদীয়মান প্রযুক্তির গতি, সুযোগ তার ব্যাঘাতের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের সঙ্গে সমন্বিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিসরে ডায়াগনস্টিকস বা রোগ নির্ণায়ক এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নত প্রযুক্তির সমন্বিতকরণ পরিসরটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে এবং এমনকি স্বাস্থ্য সাম্যের অভিমুখী গতিকেও ত্বরান্বিত করেছে।

২০২৪ সাল শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে এই নিবন্ধগুচ্ছে বর্ণিত অত্যধিক প্রবণতাগুলি আমাদের বাহ্যিক পরিবেশকে আকার দিতে থাকবে। এখানে উপস্থাপিত বিশ্লেষণগুলি আরও বিতর্কের জন্ম দেবে এবং একটি আরো ফলপ্রসূ নীতি আলোচনার দিকে পরিচালিত করবে। আমাদের লক্ষ্য হল শুধু মাত্র আমাদের পারিপার্শ্বিক বিশ্বকে বোঝা নয়, বরং আরও দূরদর্শী হওয়ার মাধ্যমে কার্যকর ভাবে তার মধ্যেও পথ খুঁজে নেওয়া।

 


নিবন্ধগুচ্ছ পড়তে ক্লিক করুন এখানে

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Editor

Harsh V. Pant

Harsh V. Pant

Professor Harsh V. Pant is Vice President – Studies and Foreign Policy at Observer Research Foundation, New Delhi. He is a Professor of International Relations ...

Read More +