Author : Ronojoy Sen

Expert Speak India Matters
Published on Sep 23, 2022 Updated 1 Days ago

সাম্প্রতিক কালে তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হলেও ভারতীয় সংসদ গণতন্ত্রের গভীরতাকেই প্রতিফলিত করে চলেছে।

ভারতীয় সংসদ কি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে?
ভারতীয় সংসদ কি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে?

১৯৪৭ সালে জওহরলাল নেহরুর স্মরণীয় ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ ভাষণের সময় থেকে বহু পথ পেরিয়ে ভারতীয় সংসদ বর্তমানে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সংস্থা। সেই ভাষণের প্রায় ৬০ বছর পরে ২০০৮ সালে সংসদের তিন সদস্যকে ভবনের অভ্যন্তরে একটি অনাস্থা ভোটের সময়ে টাকার বান্ডিল প্রদর্শন করতে দেখা যায়, যেখানে তাঁরা দাবি করেন যে, সরকারের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য তাঁদের ওই টাকা ঘুষ দেওয়া হয়। ১৯৫০-এর দশকে ভারতীয় সংসদকে প্রায়শই ঔপনিবেশিক জোয়াল থেকে সদ্যমুক্ত দেশগুলির এক উদাহরণ রূপে দেখা হত। ১৯৫২ সালে প্রথম ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনের পর ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’-এ মন্তব্য করা হয়, ‘এশিয়ায় সংসদীয় সংস্থাগুলির পূর্ব অভিজ্ঞতা বিশেষ ভাল নয়… এশিয়ায় যা কিছু ঘটছে তা সবই দিল্লির পার্লামেন্টের উপর আলোকপাত করে তাকে এমন এক সংস্থা রূপে তুলে ধরে যেটি দৃষ্টান্তমূলক ভাবে কাজ করছে।’ ১৯৫০-এর দশকে প্রকাশিত তাঁর পার্লামেন্ট সংক্রান্ত পর্যালোচনার উপসংহারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডব্লিউ এইচ মরিস-জোনস বলেন, ‘এখানে প্রতিভাত গল্পটি নিঃসন্দেহে এক সাফল্যের গল্প।’ কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে খুব কম সংখ্যক মানুষই এ কথায় সহমত পোষণ করবেন। কার্যপ্রবাহে বিঘ্নের ঘটনা এখন এক নিয়মিত ব্যাপার। সাম্প্রতিক কালে সংসদের চালু থাকার সময় এবং পাশ করা আইনের পরিমাণ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক হ্রাস লক্ষ করা গিয়েছে এবং একই সঙ্গে বিতর্ক ও কমিটির পর্যালোচনাতেও হ্রাস স্পষ্ট।

সংসদের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বলতম দিক হল সংসদের প্রতিনিধিরা।

সংসদের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বলতম দিক হল সংসদের প্রতিনিধিরা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৫২ সালে সংসদ মূলত ছিল সেই সব আইনজীবীর একটি শক্ত ঘাঁটি, যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলন এবং প্রাক্‌-স্বাধীন ভারতে আইনসভাগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও বর্তমানে সংসদ আরও বেশি করে ভারতীয় সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে। এমনটা হওয়ার নেপথ্যে তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতিদের সংরক্ষণ অথবা কোটা ব্যবস্থার আংশিক ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে গণতন্ত্রের গভীরতা বৃদ্ধিকারী একগুচ্ছ পদক্ষেপ, যেমন ১৯৮৯ সালে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের (ও বি সি) জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার জন্য মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের বাস্তবায়ন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই বৈচিত্র্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের, সদস্যসংখ্যা হ্রাস, রাজনৈতিক বংশপরম্পরা থেকে উদ্ভূত গরিষ্ঠ সংখ্যক সাংসদ, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ধনী সাংসদ এবং অপরাধমূলক অতীত সম্পন্ন সাংসদদের উপস্থিতি। মহিলা সাংসদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এবং ২০১৯ সালে তা সর্বকালীন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছলেও এখনও বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় তা অনেকটাই কম।

একই সঙ্গে সংসদের রাজনৈতিক গঠনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। একদা কংগ্রেসের আধিপত্যবিশিষ্ট সংসদ ১৯৭৭ সালে প্রথম বারের জন্য অ-কংগ্রেসি সরকারের এবং তার পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু এবং জোট সরকারেরও সাক্ষী হয়। একটি রাজনৈতিক দলের আধিপত্যের ছায়া থেকে এক বহুদলীয় ব্যবস্থায় এবং সেখান থেকে পুনরায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে একটি উদীয়মান একদলীয় ব্যবস্থায় রূপান্তর সংসদে আলোচনার মৌলিক নিয়মগুলির পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থার তাৎপর্য

আশাবাদী হওয়ার আর একটি কারণ হল সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থার কার্যকারিতা, যা প্রথম থেকেই সংসদের একটি অংশ হলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে এটির উল্লেখযোগ্য প্রসারণ ঘটে। সংসদের অধিকাংশ বিশ্লেষণই সদনের অভ্যন্তরে বাস্তবিক আলোচনায় কী হচ্ছে তার উপরে নির্ভর করলেও গুরুত্বপূর্ণ আইনি পদক্ষেপগুলি কমিটিগুলিতেই গৃহীত হয়। আর্থিক কমিটি ও অন্যান্য স্থায়ী ও অস্থায়ী কমিটির পাশাপাশি বর্তমানে বিভাগ সম্পর্কিত ২৪টি স্থায়ী কমিটি (ডি আর এস সি) রয়েছে। সংসদের অভ্যন্তরে বিরোধী রাজনীতির প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের তুলনায় সকল রাজনৈতিক দল এবং উভয় হাউস থেকে নির্বাচিত সদস্য দ্বারা গঠিত কমিটিগুলি অধিকতর সহযোগিতামূলক হয়। তা ছাড়া কমিটি ব্যবস্থা আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যখন জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়গুলির তদন্তের জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি (জে পি সি) গঠন করা হয়। ১৯৮৭ সালে এটির সূচনা হয় বোফর্স কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে। আর একটি উদাহরণ হল ২জি স্পেকট্রাম বরাদ্দ সংক্রান্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে জে পি সি কর্তৃক তদন্ত, যেটিকে ভারতের বৃহত্তম দুর্নীতি কেলেঙ্কারির একটি বলে মনে করা হয়। যদিও কমিটিগুলির কর্মপদ্ধতি, কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।

একই সঙ্গে সংসদের রাজনৈতিক গঠনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। একদা কংগ্রেসের আধিপত্যবিশিষ্ট সংসদ ১৯৭৭ সালে প্রথম বারের জন্য অ-কংগ্রেসি সরকারের এবং তার পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু এবং জোট সরকারেরও সাক্ষী হয়।

এই দশকের প্রতিবন্ধকতা

যাই হোক, ১৯৮০ সাল থেকে সংসদীয় নিয়মাবলির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে এবং হাউসের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ও বিক্ষোভের ঘটনারও ব্যাপক বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে। অনেক ভাষ্যকারই এ হেন বিশৃঙ্খলার ঘটনাকে অদক্ষ ও অকার্যকর সংসদের লক্ষণ বলে খারিজ করে দিলেও বিশৃঙ্খলার ঘটনাগুলি সংসদের পরিবর্তনশীল সামাজিক এবং রাজনৈতিক গঠন ও ২০০৬ সাল থেকে সমস্ত সংসদীয় কার্যক্রমের সরাসরি সম্প্রচারের সূচনার, যা জনসমক্ষে দেখনদারির সুযোগও প্রদান করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা উচিত। হাউসের অভ্যন্তরে বিক্ষোভের ঘটনা এবং সাংসদদের আচরণ সম্ভবত অভিজাত এবং গণসংস্কৃতির মধ্যকার সংঘাতকেই প্রতিফলিত করে, যা ব্রিটিশ সংসদীয় কর্মপদ্ধতির পরিপন্থী। এই ঘটনাপ্রবাহ সংসদের অভ্যন্তরে রাজনীতি এবং হাটুরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুপ্রবেশকেই দর্শায়, যার ফলে সংসদের আলোচনামূলক এবং আইনি কার্যপদ্ধতির উপরে প্রায়শই বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

সর্বোপরি, ভারতের রাজনৈতিক শ্রেণির সঙ্গে ক্রমশ আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়া অপরাধ  ও দুর্নীতি সংসদের বৈধতা এবং দায়বদ্ধতাকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। ১৯৫১ সালে অন্তর্বর্তী সংসদের এক সাংসদ এইচ জি মুদ্গলের বিরুদ্ধে সংসদের অভ্যন্তরে প্রশ্ন করা এবং সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করার বিনিময়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার অনেক বছর পরে ২০০৮ সালে কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাংসদদের আচরণ এবং দায়িত্বশীলতা নিয়ে একই রকমের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে। প্রসঙ্গত এই প্রশ্নও ওঠে যে, সংসদের বিশেষ অধিকার দায়িত্বশীলতার পথে প্রধান অন্তরায় কি না এবং এই বিশেষ অধিকারের অপব্যবহার রোধ করার জন্য আদৌ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আছে কি?

ভারতীয় রাজনীতির এক চিরাচরিত বিষয়, দুর্নীতি সংক্রান্ত বিতর্কও সংসদ এবং  বিচারপতিদের মধ্যে সংঘাতের পথ প্রশস্ত করেছে।

সংসদের আর একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল এক বিরাট সংখ্যক সাংসদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ থাকা। বাস্তবিক ভাবেই ১৭তম লোকসভার প্রায় ৪৩ শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। এ হেন রূঢ় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করে যে, ‘আইনভঙ্গকারীরাই আইনপ্রণেতায় পরিণত হয়েছে।’ প্রধানত জনস্বার্থ মামলাগুলির দৌলতে আদালত একাধিক ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা এবং স্বচ্ছতার উপর বিশেষ জোর দিয়েছে। এ সবই রাজনীতিবিদ-বিরোধী মনোভাবকে সুদৃঢ় করেছে। আন্না হাজারের মতো সুশীল সমাজের কর্মীরা এ হেন জনপ্রিয় মনোভাবকে ব্যবহার করে দুর্নীতিবিরোধী ন্যায়পাল বা লোকপাল – ১৯৬০ সালে যেটি প্রথম বার উত্থিত হয়েছিল – অর্জনের লক্ষ্যে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এক জনপ্রতিনিধি হওয়ার নৈতিক সততা অথবা ‘দুর্নীতি’র সঙ্গে যুক্ত আর একটি সমস্যা হল ১৯৮৫ সালের দলত্যাগ-বিরোধী আইনের অধীনস্থ দলত্যাগ ও তার পরবর্তী প্রভাবের বিষয়টি। ভারতীয় রাজনীতির এক চিরাচরিত বিষয়, দুর্নীতি সংক্রান্ত বিতর্কও সংসদ এবং বিচারপতিদের মধ্যে সংঘাতের পথ প্রশস্ত করেছে।

উপসংহার

ক্রমবর্ধমান অ-জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বিগত ৭৫ বছরে ভারতীয় সংসদ একাধিক কৃতিত্বেরও সাক্ষী থেকেছে। সংসদ গণতন্ত্রের গভীরতা বৃদ্ধিকেই প্রতিফলিত করেছে, যার প্রভার পড়েছে তার কার্যকারিতার উপরেও। এমনটা হওয়ার ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় গণপরিষদ যা অনুসরণ করেছিল, সেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম ও তার পদ্ধতিগুলির মৌলিক পুনর্বিশ্লেষণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে এ কথাও সত্যি যে, সুচিন্তিত পর্যালোচনা ও আইন প্রণয়নের পাশাপাশি প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার দায়িত্ব পালনে ভারতীয় সংসদ বিক্ষিপ্ত ভাবে সফল হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংসদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলেও তার সামনে একাধিক বাধা বিদ্যমান। পতনের সূচকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সংসদীয় কমিটির কাছে প্রেরিত বিলের সংখ্যা দ্রুততার সঙ্গে হ্রাস পাওয়া, বিরোধী পক্ষের পরিসর ক্রমশ সীমিত হয়ে আসা, অর্ডিন্যান্স জারির প্রবণতা বৃদ্ধি এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সংসদকে উপেক্ষা করা।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.