সম্প্রতি ভুটানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাষ্ট্রীয় সফরটি ছিল সে দেশে তাঁর তৃতীয় সফর। ১৪ থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে ভুটানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগের ভারতে সরকারি সফরের পরপরই প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভুটান সফরটি হয়। দুই দেশের মধ্যে বারবার ঘটা সফরগুলি আসলে উভয় দেশের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক এবং নিয়মিত উচ্চ স্তরের বিনিময়ের ঐতিহ্যকেই দর্শায়। ভারত-ভুটান সম্পর্ক আসলে এই দুই প্রতিবেশীর জন্য লাভজনক সম্পর্কের প্রতীক, যদিও দু’টি দেশের আকার ও আয়তন ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাম্প্রতিক সফর এই বিশেষ সম্পর্ককেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ঘটেছে, বিশেষ করে যখন ভুটান তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
আমলাতান্ত্রিক সংস্কার ও একটি নতুন কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে চাকরির নিরাপত্তাহীনতার ভয়ের পাশাপাশি ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দরুন সে দেশের মানুষজন ব্যাপক হারে দেশত্যাগ করে চলেছেন। বহু ভুটানি শিক্ষার্থী, সরকারি কর্মচারী এবং দক্ষ শ্রমিক অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। শুধু মাত্র ২০২২ সালেই ভুটানের জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ ১৭০০০ ভুটানি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ২০২৩ সালে প্রায় ৫০০০ সরকারি কর্মচারী পদত্যাগ করেছিলেন এবং এঁদের মধ্যে বেশির ভাগই অন্যত্র চলে গিয়েছেন। মাত্র সাত লক্ষ জনসংখ্যাবিশিষ্ট একটি দেশের জন্য এই হারে মানুষের দেশত্যাগ আসলে অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও দৈনন্দিন প্রশাসনের উপর উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাম্প্রতিক সফর এই বিশেষ সম্পর্ককেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ঘটেছে, বিশেষ করে যখন ভুটান তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
বাহ্যিক ভাবে ভুটানও ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী চিনের সম্মুখীন হচ্ছে। চিন উত্তর ও পশ্চিম ক্ষেত্রে ভুটানের সঙ্গে বিরোধিতায় নেমেছে। উত্তরে পাসামলুং এবং জাকারলুং অঞ্চলটি যেমন বিতর্কিত, তেমন পশ্চিমে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলি হল দ্রামানা ও শাখাতো, সিনচুলুংপা ও লাংমারপো উপত্যকা, ইয়াক চু ও চারিথাং উপত্যকা এবং ডোকলাম অঞ্চল। ১৯৮৪ সাল থেকে উভয় দেশ আঞ্চলিক বিরোধের অবসান ঘটাতে ২৫ দফায় আলোচনা চালিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভুটান পশ্চিমের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলি, বিশেষ করে ডোকলাম ত্রিমুখী সঙ্গম ছেড়ে দেওয়ার চিনা প্রস্তাব এই ভয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল যে, এমনটা ঘটলে ভারতের তরফে নিরাপত্তামূলক প্রতিক্রিয়া আসবে। বিদ্যমান আলোচনা সত্ত্বেও চিন রাস্তা ও বসতি নির্মাণ এবং কিছু বিতর্কিত অঞ্চলে জনবসতি স্থাপন করার কাজটি অব্যাহত রেখেছে।
২০১৭ সালে স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করার একটি প্রচেষ্টা ভারত ও চিনের মধ্যে ডোকলাম অঞ্চলে সংঘর্ষকে চালিত করে। ২০২০ সালে চিন ভুটানের পূর্ব দিকে সাক্তেং অঞ্চলের উপর নতুন দাবি জানায়, যা সম্ভবত ভারতের অরুণাচল প্রদেশের উপর চিনা দাবি থেকে উদ্ভূত। ক্রমবর্ধমান চাপের মাঝেই ভুটানের পূর্ববর্তী প্রশাসন একটি তিন ধাপের রোডম্যাপে স্বাক্ষর করে এবং চারটি বিশেষজ্ঞ দলের সভা, ২৫তম দফার আলোচনার আয়োজন করে। এর পাশাপাশি ভুটান চিনের সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার লক্ষ্য ছিল ডোকলাম অঞ্চল ছাড়া তার সমস্ত বিতর্কিত সীমানাকে চিহ্নিত করা, যেগুলি ভারত, চিন এবং ভুটানের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। ভুটান ও চিন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা চালায়।
এই চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে ভারতকে তার প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য বলে বেছে নিয়েছিলেন, যা ভারতের প্রতি থিম্পুর আস্থা ও আশাকেই দর্শায়। সফরের সময় টোবগে ১৩তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (এফওয়াইপি) উদ্দেশ্যে ১০০ বিলিয়ন টাকা এবং অর্থনৈতিক উদ্দীপনা প্যাকেজের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত ১৫ বিলিয়ন টাকা সাহায্য করার জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন। এই উদ্যোগগুলির লক্ষ্য ছিল অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন। তিনি ভুটানের গালসুং সার্ভিস প্রোগ্রামের জন্য ভারতের তরফে ১৫ বিলিয়ন ছাড়পত্রমূলক অর্থায়নকেও স্বাগত জানিয়েছেন। গালসুং সার্ভিস প্রোগ্রাম আসলে ভুটানি যুবকদের মধ্যে কর্মসংস্থানের দক্ষতা প্রদান এবং জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করার মাধ্যমে অভিবাসন কমানোর উদ্দেশ্যে একটি বাধ্যতামূলক পরিষেবা। প্রধানমন্ত্রী টোবগে আরও বেশি পরিমাণে ভারতীয় বিনিয়োগ, বাণিজ্য, এবং পরিকাঠামো, বিশেষ করে একটি ১০০০ বর্গ কিমি বিস্তৃত বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল গেলফু মাইন্ডফুলনেস সিটির জন্য মুম্বইতে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। গেলফু মাইন্ডফুলনেস সিটির লক্ষ্য হল দেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রচার চালানো এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। এ ছাড়াও, উভয় দেশ খেলাধুলো, অবকাঠামো, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, জলবিদ্যুৎ, অ-জলবিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য শক্তি, মহাকাশ, পর্যটন, রেল ও সড়ক যোগাযোগ এবং দক্ষতার ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণে সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ভারত ভুটানের অর্থনৈতিক চাপ হ্রাস করতে এবং বাণিজ্য, সংযোগ, মহাকাশ সহযোগিতা ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য আটটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে।
সাধারণ নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভুটানে প্রতি-সফর ইঙ্গিত দেয় যে, ভারত তার প্রতিবেশীর জরুরি প্রয়োজন এবং চাহিদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই সফরে ভারত ১০০ বিলিয়ন টাকা সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে, যার মধ্যে ১৩তম এফওয়াইপি-র জন্য ৮৫ বিলিয়ন টাকা এবং অর্থনৈতিক প্যাকেজের জন্য ১৫ বিলিয়ন টাকা অন্তর্ভুক্ত। এই সহায়তা মোদীর ১১তম এবং ১২তম এফওয়াইপি সহায়তার (যথাক্রমে ৪৫ বিলিয়ন টাকা এবং ৫০ বিলিয়ন টাকা) তুলনায় এক ব্যাপক বৃদ্ধিকেই দর্শায়। ভারত ভুটানের অর্থনৈতিক চাপ হ্রাস করতে এবং বাণিজ্য, সংযোগ, মহাকাশ সহযোগিতা ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য আটটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তিগুলি পেট্রোলিয়াম পণ্য, খাদ্য পণ্য এবং ওষুধের বাণিজ্যকে সহজতর করবে। সংযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে ভারত ও ভুটানের মধ্যে দু’টি রেললাইন অর্থাৎ কোকরাঝাড়-গেলপেহু এবং বানারহাট-সামত্সে লাইন স্থাপনের জন্য একটি মউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ভারতও বিশেষ করে গেলফু এসএআর-এ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংযোগ এবং পরিকাঠামো জোরদার করতে সম্মত হয়েছে।
সীমান্ত সংক্রান্ত আলোচনায় ভারত পারস্পরিক নিরাপত্তা বিষয়ে ভুটানের সহযোগিতার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে। এটি আসলে দর্শায় যে, ভারত সীমান্ত চিহ্নিত করার জন্য ভুটানের আবশ্যিকতা এবং বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। প্রকৃতপক্ষে ২০২০ সালে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিল যে, গলওয়ান সংঘর্ষের পরে ভারত ভুটানকে তার বিরোধিতা শেষ করতে উত্সাহিত করেছিল, যাতে তিনটি দেশই জটিল ডোকলাম সমস্যা সমাধান করতে পারে। মনে করা হচ্ছে, নিয়মিত সহযোগিতা এবং তথ্য আদান-প্রদান সত্ত্বেও ভারত সীমান্ত বিরোধ ও ভুটানি অঞ্চলের সম্ভাব্য হস্তান্তরকে ভুটান চিনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কজনিত সমস্যা বলেই মনে করে, যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ট দুই দেশ ডোকলামের মতো ভারতীয় স্বার্থের ক্ষতি না করে।
সীমান্ত সংক্রান্ত আলোচনায় ভারত পারস্পরিক নিরাপত্তা বিষয়ে ভুটানের সহযোগিতার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে।
যাইহোক, ভারত-চিন প্রতিযোগিতা তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেজিং ভারতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করার প্রয়াসে এই অঞ্চলের জন্য কর্মসূচি নির্ধারণের চেষ্টা করবে। ডোকলামের জন্য একটি ত্রিপাক্ষিক সমাধান বিলম্বিত করার পাশাপাশি অরুণাচল প্রদেশের উপর চিনের ভিত্তিহীন দাবিগুলি ভুটানের সাক্তেং অঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে তার দাবি ও বাগাড়ম্বরকে তীব্র করে তুলবে। এই আগ্রাসন ভুটান ও এর সীমান্ত আলোচনার কৌশলকে আরও চাপের মুখে ফেলবে। এ ছাড়াও একটি দুর্বল ভুটানি অর্থনীতিও আরও বেশি চিনা অর্থনৈতিক প্রভাব এবং দেশটির অভ্যন্তরে চিনকে প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। উদাহরণস্বরূপ, চিনের সঙ্গে ভুটানের বাণিজ্য ২০২০ সালে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে শুধু মাত্র ২০২২ সালে ১৫ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হয়েছে। চিন ও ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করায় এই বাণিজ্যের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এই প্রেক্ষিতে, নয়াদিল্লি এ বিষয়ে অবগত যে, হিমালয় অধ্যুষিত অঞ্চলটিতে তাকে সাবধানী পদক্ষেপ করতে হবে। আপাতত ভারতের বার্তা স্পষ্ট ও দৃঢ় এবং তা হল… প্রয়োজনে ভারতে তার সর্বকালীন বন্ধু এবং প্রতিবেশীর পাশেই দাঁড়াবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.