Author : Harsh V. Pant

Published on May 31, 2024 Updated 0 Hours ago
ইউরোপে শি জিনপিং: উদ্দেশ্য বন্ধুত্ব পাতানো ও জনমানসে প্রভাব বিস্তার

এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।

 


চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম বার ইউরোপে সফরের সময় মহাদেশটির নানা দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন এবং সেখানকার জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। বেজিং যখন তার বৃহত্তর বিদেশনীতির দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্মূল্যায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে প্রায় সব ক্ষেত্রেই চাপানউতোরের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চলেছে, তখন চিন ইউরোপকেই গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) জন্য অগ্রাধিকার হল চিনা অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং সেই লক্ষ্যে ইউরোপের সঙ্গে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার দরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে ইউরোপের ভূমিকা চিনেজন্য তার বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে

সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন-চিন সম্পর্ককে ইতিবাচক করে তোলার জন্য বেশ কিছু অস্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চিনে তাঁর তিন দিনের সফর শেষে স্পষ্টতই বলেছিলেন যে, বেজিং ‘বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ হুমকির আগুনে আরও বেশি  উস্কানি দেওয়ার কাজ করছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের পর থেকে রাশিয়া ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে এবং চিন যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র রাশিয়াকে সরবরাহ করা বন্ধ না করলে ওয়াশিংটন ব্যবস্থা নেবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই পর্যায়ে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার চাপানউতোরের সম্পর্ক সামলানোর  চেয়ে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করা চিনের কাছে একটি সহজতর বিকল্প বলে মনে হচ্ছে।

 

ইউরোপের মধ্যে বিভাজন

শি-সাম্প্রতিক ফরের মাধ্যমে আসলে পশ্চিমের কাছে এ স্পষ্ট বার্তাই প্রেরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, চিন কেবল ফ্রান্সের মতো চিরাচরিত শক্তির সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য নয়, বরং সার্বিয়া হাঙ্গেরির মতো নতুন অংশীদারের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনে রত, যারা এক সময় মস্কোর মিত্র থাকলেও বর্তমানে চিনা অর্থনৈতিক শক্তির দরুন চিনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। ফ্রান্সে বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্য শি তেমন বিশেষ চেষ্টাই করেননি। শি স্পষ্টতই বলেছেন যে, চিইউক্রেন সংঘাতকে মদত দেওয়া, তৃতীয় কোন দেশকে আঘাত হানা এবং কোনও নতুন ঠান্ডা লড়াইয়ে স্কানি দেওয়াঘোর বিরোধী। এর পাশাপাশি শি ঘোষণা করে যে, তিনি অলিম্পিক ট্রুস’ সংক্রান্ত ফরাসি প্রেসিডেন্টের আহ্বানকে সমর্থন করেন। বেজিং ইতিবাচক ভাবেই স্বীকার করে নিয়েছে যে, প্যারিস কিছু অর্থহীন অনুশীলন করলেও এবং অলীক স্বপ্ন দেখলেও বেজিং ফ্রান্সের অহংকে পুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন নীতিপ্রেক্ষিত তুলে ধরাকে ক্ষতিকর বলে মনে করে না।

 

ইউরোপ এবং চিন উভয়ই একে অপরের বাজারে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে, তবে বাজারে প্রবেশাধিকারে বাধা এবং বিনিয়োগের বিধিনিষেধ এখনও অব্যাহত হয়েছে।

 

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ উভয়েই বেজিংয়ের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে চিনকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বিভাজন স্পষ্টতই প্রকাশ্যে এসেছে। ইউরোপে চিন সম্পর্কে ধারণার নাটকীয় পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এমনটা ঘটেছেযে বিষয়টিকে এক সময় বাধ্যতামূলক উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হত অর্থাৎ বাণিজ্য বর্তমানে এই বিবাদের প্রধান কারণ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউরোপ এবং চিন উভয়ই একে অপরের বাজারে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে, তবে বাজারে প্রবেশাধিকারে বাধা এবং বিনিয়োগের বিধিনিষেধ এখনও অব্যাহত রয়েছে। ইউরোপ ন্যায্য প্রতিযোগিতা, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি এবং চিনে বুদ্ধিবৃত্তিগত সম্পত্তির অধিকার রক্ষার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং অন্য দিকে চিন ইউরোপীয় বাজার প্রযুক্তি স্থানান্তরে আরও বেশি পরিমাণে প্রবেশাধিকার চায়।

 

চিনা বিনিয়োগ কিছু দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

ইউরোপীয় দেশগুলি চিনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের পারস্পরিক সম্পর্কহীনতার সমালোচনা করেছে। ইউরোপীয় বাজারগুলি চিনা বিনিয়োগের জন্য তুলনামূলক ভাবে উন্মুক্ত হলেও অন্যায্য প্রতিযোগিতা বলপূর্বক প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে উদ্বেগ-সহ ইউরোপীয় সংস্থাগুলির জন্য চিনা বাজারে প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ থেকেছে। ইউরোপ চিনের ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত ক্ষমতা এবং সাইবার নিরাপত্তার উপর তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক। হুয়াইয়ের মতো চিনা টেলিকমিউনিকেশন সংস্থাগুলিকে নিয়ে উদ্বেগ এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে তাদের জড়িত থাকার কারণে কিছু ইউরোপীয় দেশ তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্ভাব্য গুপ্তচরবৃত্তির কারণে সংস্থাকে নিজেদের নেটওয়ার্কে সীমাবদ্ধ রেখে অথবা তা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছে।

তবে ইউরোপের কিছু অংশ চিনে নিজেদের উপস্থিতি অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চিন ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও চিনের সঙ্গে সার্বিয়ার সম্পর্ক ত্বরান্বিত হয়েছেগত বছর দুই দেশ একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা তাদের ‘সর্বাত্মক বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করে এবং ২০১৬ সালে শি-র সার্বিয়া সফরের আগে এই চুক্তির কথা প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল। বেলগ্রেডের পরে চিনের প্রেসিডেন্ট বুদাপেস্টে যান, যেখানে হাঙ্গেরির প্রাইম মিনিস্টার ভিক্টর অরবান ইইউ নেতাদের মধ্যে শি-প্রধান মিত্র হিসাবে উঠে এসেছেন।

 

গত বছর দুই দেশ একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা তাদের ‘সর্বাত্মক বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করে এবং ২০১৬ সালে শি-র সার্বিয়া সফরের আগে এই চুক্তির কথা প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল।

 

ইলেকট্রিক গাড়ি সংস্থা বিওয়াইডি-র কারখানার মতো প্রকল্পগুলি অরবানকে বিভিন্ন বিষয়ে ইইউ-এর ঐকমত্যকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দিয়েছে এবং চিনা বিনিয়োগগুলিও সে ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হাঙ্গেরীয় সরকার চিনা বিনিয়োগের জন্য চুক্তিটিকে মধুর করে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং মধ্য ইউরোপকে থেসালোনিকি পাইরাস বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য একটি উচ্চ গতির রেলপথ প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। এর পাশাপাশি শি-র সার্বিয়া এবং হাঙ্গেরি সফরও ইউরোপের নির্দিষ্ট কিছু অংশে চিনের প্রতি উৎসাহকেই দর্শায়।

 

প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ এবং মূল্যবোধ

ইউরোপের মধ্যে চিন সংক্রান্ত এই বিভাজনগুলি কেবলমাত্র তার সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে স্বার্থ এবং উদ্বেগের বলয়ে সাযুজ্য রেখে বৃদ্ধি পেতে চলেছে। কিছু দেশ যখন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে চিনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার এবং বিনিয়োগের উত্স হিসাবে মনে করে, তখন অন্য দেশগুলি বেজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, বিশেষত মানবাধিকার, গুজব এবং ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে আরও বেশি শঙ্কিত হয়ে উঠছে। উপরন্তু, অবকাঠামো সংযোগ, প্রযুক্তির গুণমান, ৫জি নেটওয়ার্ক এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক আরও দানা বেঁধেছে। ইউরোপের মধ্যে এই বিভাজনগুলি প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ মূল্যবোধের মাঝে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জটিলতাগুলিকে তুলে করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্রতর হয়ে উঠলে ইউরোপের কাজের পরিসর কেবল সঙ্কুচিত হবে এবং পশ্চিমের অভ্যন্তরে থাকা ফাটলগুলিকে কাজে লাগাতে বেজিংয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

নয়াদিল্লির জন্য ইউরোপ সাযুজ্যপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক বিশ্বদর্শন ভাগ করে নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ক্ষমতার ভারসাম্যের চাপানউতোর পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় কণ্ঠস্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত আশা করবে যে, শি জিনপিংয়ের সফরের সময় ইউরোপের মধ্যে বিভাজনগুলি যেন দুর্বল কৌশলগত পদক্ষেপে রূপান্তরিত না হয়। তাই ইউরোপের সঙ্গে ভারতের নিজস্ব সম্পৃক্ততা নিবিড় এবং দূরদর্শী হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.