Author : Sohini Bose

Published on Jun 26, 2024 Updated 0 Hours ago

ভারতের বিদেশসচিবের বাংলাদেশ সফর সময়োপযোগীকারণ বাংলাদেশে চিনের গভীর উপস্থিতির সামনে ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বকে পুনরায় নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে।

ভারতের ‘প্রতিবেশ প্রথম’ নীতিতে ঢাকার কেন্দ্রীয়তা পুনর্নিশ্চিত করা

ভারতের বিদেশসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ৮-৯ মে দুদিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশ যান। সফরকালে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী হাসান মাহমুদ এবং বিদেশসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বেশ কিছু কারণে কূটনৈতিক ভাবে এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর এটি ছিল প্রতিবেশী দেশে ভারতের তরফে প্রথম উচ্চ স্তরের সরকারি সফর, তাই এটি ঢাকার প্রতি নয়াদিল্লির অগ্রাধিকার প্রদর্শন করে। এটি এই বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী হাসান মাহমুদের নয়াদিল্লি কলকাতা সফরের পর ঘটে এবং এই গ্রীষ্মে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরের ভিত্তি তৈরি করে। ভারতের বা বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রবৈঠকের কোন বিশদ প্রকাশ না করলেও জানা গিয়েছে যে, দুই পক্ষ তিস্তা নদী-সহ অভিন্ন নদীগুলির জল বণ্টন নিয়ে এবং ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার জল বণ্টন চুক্তির পুনর্নবীকরণ নিয়েও আলোচনা করেছে। মাহমুদ বলেন, আপনি জানেন আমরা তিস্তা নিয়ে একটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ভারত এর জন্য অর্থায়ন করতে চায়। আমরা বলেছি প্রকল্পটি আমাদের চাহিদা অনুযায়ী হতে হবে; টা অবশ্যই আমাদের চাহিদা পূরণ করবে। তিস্তা প্রসঙ্গটি বাংলাদেশে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ভারতের আশঙ্কার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই বৈঠকটি ঘটে।

 

চিনের সম্ভাব্য আস্তানা

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে চিনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন যে, তিনি আশা করেন, তিস্তা প্রকল্পটি দ্রুতই আবার শুরু হবেঢাকার তিস্তা নদীর ব্যাপক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বেজিংয়ের ২০২২ সালের প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেন তিনি, যার মূল্য ছিল বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যাই হোক, এই প্রস্তাবটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার জল বণ্টনের দীর্ঘস্থায়ী দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার একটি স্তর যুক্ত করেছে, যা অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে। কারণ এটি ভারতের ফেডারেল রাজনীতি দ্বারা আচ্ছন্ন, যার ফলে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে পৌঁছনো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিস্তা প্রকল্পে চিনেসম্পৃক্ততা ‘ড্রাগন’ অর্থাৎ চিনকে ভারতীয় সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে নিয়ে আসবে। এটি বিশেষ ভাবে উদ্বেগজনক কারণ এটি শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি একটি সরু প্রসারিত ভূমি এবং একমাত্র স্থল সংযোগ, যা ভারতের মূল ভূখণ্ডকে তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করে। এটি ভারত সরকারের জন্য একটি সংবেদনশীল অঞ্চল কারণ এটি অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তে চিনেসঙ্গে সীমান্ত বিরোধপূর্ণ।

 

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে চিনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন যে, তিনি আশা করেন, তিস্তা প্রকল্পটি দ্রুতই আবার শুরু হবে। ঢাকার তিস্তা নদীর ব্যাপক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বেজিংয়ের ২০২২ সালের প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেন তিনি, যার মূল্য ছিল ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

হেন পরিস্থিতিতে তিস্তা নদীতে জলাধার নির্মাণের ভারতের কথিত প্রস্তাব আশাব্যঞ্জক। উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে, এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি বড় বাধার সমাধান করবে। এখন পর্যন্ত বেজিংয়ের প্রস্তাব গ্রহণে ঢাকার বিরতি, মন প্রস্তাব গ্রহণ করার আগে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি এবং এই ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত থেকে ফিরে আসার পর তিস্তা সমস্যার দ্রুত সমাধানের বিষয়ে মাহমুদের আশাবাদসবই নয়াদিল্লিকে আশ্বস্ত করেছে। যাই হোক, যতক্ষণ না বাংলাদেশ দুটি প্রস্তাবের মধ্যে একটি প্রস্তাবকে প্রকৃত বাছাই করে বা একটি মধ্যম পন্থা বেছে নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতের আশঙ্কা বজায় থাকবে।

বাংলাদেশে চিনের বর্ধিত উপস্থিতি ও বিনিয়োগের বাস্তবতা অনস্বীকার্য। বর্তমানে, বেজিং ঢাকার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) তৃতীয় বৃহত্তম উৎস এবং বিদেশি সাহায্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদানকারী। ঢাকায় অন্যান্য বৈদেশিক সাহায্যের মতো চিনের বেশির ভাগ সহায়তা উন্নয়নমূলক প্রকল্প নির্মাণের দিকে পরিচালিত হয়। এর ফলস্বরূপ, বেজিং পদ্মা বহুমুখী রেল ও সড়ক সেতু, কর্ণফুলী নদী টানেল এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে জড়িত রয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য চিনের কাছ থেকে আরও বিনিয়োগের অনুরোধ করেছেন এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে দেশকে মুক্তি দিতে বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কূটনৈতিক ঋণেরও অনুরোধ করেছেন।

বেসামরিক উদ্যোগের পাশাপাশি চিন চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার উপকূলে বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি বিএনএস শেখ হাসিনা নির্মাণ করেছে। চিন বাংলাদেশের অস্ত্রেরও একটি বড় উৎস; যদিও সম্প্রতি ঢাকা চিনা অস্ত্র সরবরাহের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবুও, এই মাসে নির্ধারিত আসন্ন প্রথম চিন-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মহড়াটি আবারও অংশীদারিত্বকে উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষার সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানে মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত হাসিনার তরফে একটি কূটনৈতিক চালও বটে, যা হাসিনা সরকারের সন্ত্রাসবাদের প্রতি শূন্য সহনশীলতা’মূলক অবস্থানের উপর জোর দেয়। চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সৈন্যরা বাংলাদেশে যাচ্ছে, যেখানে তারা ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চিন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে মহড়া চালাবে।

 

রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষার সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানে মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত হাসিনার তরফে একটি কূটনৈতিক চালও বটে, যা হাসিনা সরকারের ‘সন্ত্রাসবাদের প্রতি শূন্য সহনশীলতা’মূলক অবস্থানের উপর জোর দেয়।

 

তা সত্ত্বেও, আওয়ামি লিগ সরকার সর্বদা সচেতন ভাবে ভারত ও চিনের মধ্যে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে। যাই হোক, নয়াদিল্লি স্বাভাবিক ভাবেই তার প্রতিবেশ অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত। কারণ ভারতের নিরিখে বাংলাদেশ এমন একটি অঞ্চল যা দেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ এবং ভারতের বৈদেশিক নীতির উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রসঙ্গে হাসিনা সরকারকে লক্ষ্যবস্তু করার অর্থই হল কেবল ঢাকাকে বেজিংয়ের কাছাকাছি এগিয়ে দেওয়া।

 

কূটনীতিকের আত্মপক্ষ সমর্থন

এই ভাবে সাম্প্রতিক সফরটি এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তে ঘটেছে, যখন বাংলাদেশে ড্রাগন’ বা চিনের গভীরতর উপস্থিতির সম্মুখে ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বকে পুনরায় নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। সেই অনুসারে, তিস্তা প্রসঙ্গ, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তার মতো অভিন্ন সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রেও আলোচনা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি, সংযোগ এবং প্রতিরক্ষা, দূষণহীন জ্বালানি, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতার উদীয়মান সুযোগ

ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের শক্তিকে পুনরুদ্ধার করা অত্যাবশ্যক কারণ বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে, বিরোধীদের একাংশ দ্বারা উদ্দীপ্ত ‘ইন্ডিয়া আউট’ এবং ‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস’ প্রচারাভিযানে তা প্রকাশ পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের জনগণকে ভারত থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া এবং দেশে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি মেনে নেওয়ার ক্ষমতাকেই দর্শায়। এই ভাবে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দেশের কথিত ক্ষয়প্রাপ্ত সদিচ্ছা পুনরুদ্ধার করার জন্য ভারতের তরফে চ্যালেঞ্জগুলি সমাধানের আশ্বাস এবং সহযোগিতার মাইলফলক সম্পর্কে অনুস্মারক প্রয়োজন।

ভারত ও বাংলাদেশ তাদের ভৌগোলিক সংলগ্নতা অভিন্ন সাধারণ সম্পদ-সহ প্রাকৃতিক অংশীদার এবং দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা তাদের পারস্পরিক উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সমানুপাতিক। ভারতের বিদেশসচিবের সফর আসলে ‘চিন-বাংলাদেশ সোনালি বন্ধুত্ব ২০২৪’ যাতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’কে অতিক্রম না করে, তা নিশ্চিত করতে পারস্পরিক নির্ভরতাকে পুনর্ব্যক্ত করে।

 


সোহিনী বোস অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.