এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য টেলিগ্রাফ-এ।
ইজরায়েলের উপর হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার এক বছর পর – যে যুদ্ধে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন - মধ্যপ্রাচ্য এক ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের জালে জড়িয়ে পড়েছে এবং সংঘাত কমার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইজরায়েলের উপর সেই ভয়ঙ্কর হামলার পর থেকে বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী গাজায় ইজরায়েলের অভিযানের ফলে প্রায় ৪২০০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যে, ‘সংঘাতের এই বছরে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’ ইজরায়েল, হামাস এবং হিজবুল্লাহ গত বছরের অক্টোবর মাসের হামলার বার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য নতুন আক্রমণ শুরু করতে ব্যস্ত ছিল। এটি মনে করিয়ে দেয় যে, প্রয়োজন না হলেও মধ্যপ্রাচ্যের ভয়ঙ্কর বিশ্বে যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আকার দিতে থাকবে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসবাদী হামলার পর নব্য-রক্ষণশীলরা কৌশলগত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, অঞ্চলটিকে ইসলামি চরমপন্থার হাত থেকে বের করে আনার জন্য মার্কিন সামরিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা দরকার। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের পর থেকে এই ধারণাটিকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই ধারণাই এখন আবার ফিরে আসছে। এটিকে সেই সকল ইজরায়েলি নেতা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে আনছেন, যাঁরা নিজেদের সাম্প্রতিক কৌশলগত লাভগুলিকে আঞ্চলিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠনের কারণ হিসাবে মনে করেন।
ইজরায়েলি প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও সরাসরি ইরানিদের কাছে এই বার্তা দিয়েছেন যে, তাদের শাসনের পরিবর্তন এ বার সময়েরই অপেক্ষা।
ইজরায়েলের প্রাক্তন প্রাইম মিনিস্টার নাফতালি বেনেটের মতে, এটি ‘মধ্যপ্রাচ্যের ভাবমূর্তি পরিবর্তন করার নিরিখে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুযোগ’। এর পাশাপাশি তিনি এই ইঙ্গিতও দেন যে, ইজরায়েলের উচিত ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলির উপর হামলা চালানো, যাতে ‘এই সন্ত্রাসবাদী শাসনকে মারাত্মক ভাবে পঙ্গু করে দেওয়া যায়’। ইজরায়েলি প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও সরাসরি ইরানিদের কাছে এই বার্তা দিয়েছেন যে, তাদের শাসনের পরিবর্তন এ বার সময়েরই অপেক্ষা।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই এ হেন আড়ম্বরপূর্ণ রাজনৈতিক প্রকল্পের কবরখানা হয়ে থেকেছে। সম্ভবত সে কারণেই প্রধান শক্তিগুলি তাদের নিজ নিজ যুদ্ধের স্বর তুলে এগিয়ে চলেছে। চারিদিকে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। গত অক্টোবরে ইজরায়েলের উপর হামলা যদি ইজরায়েলি নিরাপত্তা আবরণের দুর্ভেদ্য প্রকৃতির মিথকে চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দিয়ে থাকে, তা হলে হামাস এবং হিজবুল্লাহ-র উপর ইজরায়েলের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমীকরণে ইরানের ঊর্ধ্বতন হওয়ার মেকি প্রচারকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। অন্তত এখনকার মতো ইজরায়েল এই ধারণা ভেঙে দিতে সমর্থ হয়েছে যে, ইরানের ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ ইজরায়েলকে নিরস্ত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। ইজরায়েলের ‘এস্কেলেট টু ডি-এস্কেলেট’ বা ‘তীব্রতা হ্রাসের জন্য তীব্রতা বৃদ্ধি’ নীতির অর্থ হল একাধিক অভিমুখ খুলে দেওয়া এবং এগুলি সবই ইরানকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করার জন্য চাপ দেওয়া। তেহরানের শাসনব্যবস্থার জন্য – যে আসলে দাবি করে এসেছে যে, তারা ‘জায়নিস্ট বাহিনী’'র বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম - পিছিয়ে পড়া সত্যিই কোনও বিকল্প নয়।
দ্বন্দ্ব অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছে। ইজরায়েলি সমাজ - যা গত অক্টোবর মাসের ক্ষয়ক্ষতি ও দুঃস্বপ্নের ক্ষোভ দ্বারা একত্রিত – রাজনৈতিক ভাবে ভীষণ রকমের বিভাজিত। নেতানিয়াহু একজন বিভাজনকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখেছেন এবং তাঁর রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাকেই তাঁর বিরোধীরা এই সংঘাতের নিরিখে তাঁর অতি ক্ষমতা প্রদর্শনের মনোভাবের চালিকাশক্তি বলে মনে করেন। তা সত্ত্বেও বিগত কয়েক সপ্তাহে নেতানিয়াহু একটি ‘ব্যাপক প্রতিশোধ’-এর প্রতিশ্রুতিও প্রদান করছেন বলে মনে হচ্ছে, যা হামাসের নির্মূলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হামাস এবং হিজবুল্লাহকে সামরিক ভাবে লক্ষ্যবস্তু করার ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর সাফল্য তাঁর সামরিক বাহিনীর জমি সশক্ত করেছে, যদিও কৌশলগত সাফল্য বলপ্রয়োগের নেপথ্যে কৌশলগত যুক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
নেতানিয়াহু একজন বিভাজনকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখেছেন এবং তাঁর রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাকেই তাঁর বিরোধীরা এই সংঘাতের নিরিখে তাঁর অতি ক্ষমতা প্রদর্শনের মনোভাবের চালিকাশক্তি বলে মনে করেন।
পশ্চিমীরা নেতানিয়াহুকে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। কারণ নেতানিয়াহু বাইডেনের প্রস্তাবিত ‘মহান দর কষাকষি’কে টেক্কা দিতে সমর্থ হয়েছেন। এই দর কষাকষিতে সৌদি আরব ও ইজরায়েলের মধ্যে একটি বৃহত্তর কূটনৈতিক স্বাভাবিকীকরণের জন্য ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল এবং প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে, এই সময়ে ফিলিস্তিনিদের যে কোনও রকমের রাষ্ট্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হামাসের জন্য ব্যাপক জয়ের নামান্তর। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গাজায় ব্যবহারের জন্য ইজরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে নেতানিয়াহু ম্যাক্রোঁর পদক্ষেপের নিন্দা করেন।
ইজরায়েল অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন করতে সাময়িক ভাবে সফল হলেও কৌশলগত পরিবর্তন এখনও ততটা স্পষ্ট নয়। নিজের প্রতিপক্ষদের ধ্বংস করা ছাড়া তেল আভিভের অন্য কোনও রাজনৈতিক পরিকল্পনা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য বিশেষ লাভজনক হবে না। এত দিন ধরে ইজরায়েলিরা যে যন্ত্রণা এবং দুঃস্বপ্ন বয়ে চলেছিলেন, বর্তমানে গাজার মানুষ তা বয়ে চলেছেন। এই সংযুক্ত দুঃস্বপ্ন নিশ্চিত ভাবেই দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য আদর্শ নয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.