Published on Jun 21, 2024 Updated 0 Hours ago

ভারত-মায়ানমার সীমান্তের জটিল ভূসংস্থান এবং উভয় দিকের অভিন্ন সাধারণ জাতিগত সম্পর্ক সীমান্তে বেড়া দেওয়ার উদ্যোগকে জটিল করে তুলেছে।

ইন্দো-মায়ানমার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার উদ্যোগ: প্রয়োজনীয়তা এবং প্রতিবন্ধকতা

ভূমিকা

সাম্প্রতিক কালে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে যে, ভারত মায়ানমারের সঙ্গে ১৬১০ কিলোমিটারেরও বেশি বিস্তৃত তার আন্তর্জাতিক সীমান্তে বেড়া দিতে ৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করছেএই উদ্যোগটি ভারত সরকারের মায়ানমারের সঙ্গে ফ্রি রেজিম মুভমেন্ট (এফএমআর) চুক্তি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের পরপরই নেওয়া হয়েছে। আগে দুই দেশের মানুষ ভিসা ছাড়াই সীমান্ত অতিক্রম করে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চলে অবাধে যাতায়াত করতে পারত। এফএমআর বন্ধ করা এবং সীমান্তে কঠোর সামরিক চেকপয়েন্ট বাস্তবায়নকে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে (এনইআর) মাদক পাচার এবং মায়ানমারের শরণার্থীদের আগমনের মতো অব্যাহত চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধ করার  জন্য সময়োপযোগী ব্যবস্থা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। যাই হোক, এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতা স্বীকার করা অপরিহার্য। ভারত-মায়ানমার সীমান্তের জটিল ভূ-সংস্থান এবং উভয় পাশে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে অভিন্ন সাধারণ জাতিগত বন্ধন এই সিদ্ধান্তের কার্যকর বাস্তবায়নকে জটিল করে তোলে। এই কারণে নয়াদিল্লির এই নীতি বাস্তবায়নের আগে এনইআর রাজ্যগুলির আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি বিবেচনা করা উচিত

 

ভারত-মায়ানমার সীমান্তের জটিল ভূ-সংস্থান এবং উভয় পাশে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে অভিন্ন সাধারণ জাতিগত বন্ধন এই সিদ্ধান্তের কার্যকর বাস্তবায়নকে জটিল করে তোলে।

 

কেন সীমান্তে বেড়া দেওয়া জরুরি? 

১৯৭০ সাল থেকে ভারতের এনইআর প্রাথমিক ভাবে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল-এর নৈকট্যের কারণে - উত্তর-পশ্চিম মায়ানমার, উত্তর লাওস এবং উত্তর-পশ্চিম তাইল্যান্ডকে ঘিরে থাকা ভৌগোলিক অঞ্চল যা বিশ্বের মাদক পাচারের অন্যতম বড় কেন্দ্র - মাদক পাচারের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মোকাবিলা করছেএই ভৌগোলিক নৈকট্য বেড়াহীন ভারত-মায়ানমার সীমান্তের মাধ্যমে ভারতে মাদকদ্রব্যের যথেষ্ট প্রবাহকে সহজতর করে তোলে, যার ফলে ভারতের এনইআর-এর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উপর উল্লেখযোগ্য রকমের প্রভাব ফেলে। ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ আফিম উত্পাদক হিসাবে মায়ানমারের উত্থান, অবৈধ ফসলের চাষ ৯৯০০০ থেকে ১১৬০০০ একর পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার দরুন এনইআর-এ মাদক পাচারের হুমকি তীব্রতর হয়েছে। সরকারি প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে এনইআর রাজ্যগুলি একাই ২০০০ কোটি টাকার (প্রায় ২৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে অসম একাই ৭১৮ কোটি টাকা (৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) মূল্যের ওষুধ বাজেয়াপ্ত করে এবং ৪৭০০ জনেরও বেশি মাদক পাচারকারীর আশঙ্কা সেই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। একই ভাবে, মণিপুরি পুলিশ ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ১৬১০ কোটি টাকার (প্রায় ১৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) মাদকদ্রব্য আটক করেছে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এনইআর-এ পাচারকৃত মাদকের ৯০ শতাংশ মায়ানমার থেকে আসে ২০২৪ সাল এই সম্পর্কিত প্রবণতার  ধারাবাহিকতা দর্শিয়েছে, যেমনটা বেশ কয়েকটি এনইআর রাজ্যে মাদকদ্রব্য আটকের রিপোর্টেও সামনে এসেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের একটি মূল্যায়ন দর্শায় যে, অসম ৪৫৪ কোটি টাকা (প্রায় ৫৪.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) পরিমাণের মাদকদ্রব্য আটক করেছে। পাচার করা প্রাথমিক পদার্থের মধ্যে রয়েছে হেরোইন, ইয়াবা ট্যাবলেট, গাঁজা, ব্রাউন সুগার ইত্যাদি। এই অবৈধ মাদকদ্রব্যগুলি ভারতের এনইআর দিয়ে পাচার করা হয়, মণিপুর এবং মিজোরাম মূল ভূখণ্ডের ভারতে পরবর্তী বিতরণের জন্য ট্রানজিট রুট হিসাবে কাজ করে।

 

প্রাথমিক ভাবে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির পাশাপাশি একটি ভূমিবেষ্টিত এবং স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসাবে ভবিষ্যতে স্থানীয় মিজো এবং আগত উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সম্পদের জন্য সম্ভাব্য প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

আর কটি কারণ হল ভারতের এনইআর, বিশেষ করে মিজোরাম এবং মণিপুরে মায়ানমারের শরণার্থীদের আগমন। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরে মণিপুর উদ্বাস্তু সংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় (মেইতেই) এটিকে বিদ্যমান সংঘাতের অন্যতম প্রধান কারণ বলে দর্শিয়েছেন। মিজোরাম অভিন্ন সাধারণ জাতিগত ভিত্তিতে এই শরণার্থীদের স্বাগত জানালেও এই শরণার্থী গ্রহণের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব সম্পর্কে অনিশ্চিত প্রাথমিক ভাবে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির পাশাপাশি একটি ভূমিবেষ্টিত এবং স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসাবে ভবিষ্যতে স্থানীয় মিজো এবং আগত উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সম্পদের জন্য সম্ভাব্য প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে। তার উপরে মায়ানমারে তাতমাডো এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান সংঘর্ষের কারণে হিংসার হাত থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই উদ্বেগগুলি অভিবাসন থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় ভারত-মায়ানমার সীমান্তে কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাকেও দর্শায়।

 

প্রতিবন্ধকতাগুলি কী কী?

এফএমআর বাতিল করার জন্য ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত এবং সীমান্তে বেড়া দেওয়ার প্রস্তাব এনইআর-এর প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সংস্থাগুলির তরফে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অস, অরুণাচল প্রদেশ এবং মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীরা নয়াদিল্লির সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁদের সমর্থন দর্শিয়েছেন এই যুক্তি দিয়ে যে, এই ধরনের পদক্ষেপ সীমান্তের বিদ্রোহ, অবৈধ উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশ এবং নিরাপত্তাহীন ভারত-মায়ানমার সীমান্তের মাধ্যমে মাদক পাচার রোধ করার জন্য অপরিহার্য। এর বিপরীতে আবার বিজেপি শাসনের অধীনে থাকা সত্ত্বেও নাগাল্যান্ড কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। মিজোরাম বিধানসভাও দুমাস আগে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে একটি প্রস্তাব পাস করেছিল। আর কটি জটিলতা হল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অ নাগাল্যান্ডের বিরোধিতা (ইসাক মুইভা) - একটি বিশিষ্ট নাগা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যা বর্তমানে ভারত সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির অধীনে রয়েছে। তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, এটি সীমান্তের উভয় পাশে নাগা সম্প্রদায়ের দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত বন্ধনকে ব্যাহত করবে। এই অবস্থান একটি সমন্বিত নাগা স্বদেশের জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষাকে দর্শায় এবং ‘নাগালিম’ অর্থাৎ ভারত এবং মায়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই ভাবে বেড়া দেওয়া এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষাকে আরও দৃঢ় করতে পারে, যার ফলে ভারতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপড়েন বাড়তে পারে এবং ভারত থেকে তাদের দূরত্ব তৈরি হতে পারে। সরকার এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যস্থতা না করা হলে পরিস্থিতি বিদ্যমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

 

এই ভাবে বেড়া দেওয়া এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষাকে আরও দৃঢ় করতে পারে, যার ফলে ভারতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপড়েন বাড়তে পারে এবং ভারত থেকে তাদের দূরত্ব তৈরি হতে পারে।

 

ভারত-মায়ানমার সীমান্তে এই উল্লেখযোগ্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি তাদের আন্তঃসম্পর্ককেও দর্শায়। এই জনসংখ্যাগত বাস্তবতা প্রস্তাব করে যে, সীমান্তে বেড়া দেওয়া এবং এফএমআর বাতিল করা সম্ভবত উভয় পক্ষের মানুষের প্রাথমিক অভিযোগ হবে। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত বিদ্যমান জনগণের সঙ্গে মানুষের সংযোগকে ব্যাহত করতে পারে, যা ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-মায়ানমার সীমান্তের ভৌগোলিক জটিলতা সীমান্ত উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। ভূখণ্ডটি দক্ষিণে নিচু পর্বত থেকে উত্তরে এবড়োখেবড়ো শৃঙ্গ এবং চূড়া পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়। এই লজিস্টিক অসুবিধাগুলি নয়াদিল্লির উদ্যোগগুলিকে আরও জটিল করে তোলে তা ছাড়া অতীতে সীমান্ত প্রকল্পের এ ধরনের উদ্যোগ অনেকাংশে অকার্যকর ছিল; উদাহরণস্বরূপ, মণিপুর-মায়ানমার সীমান্তে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেড়া দিতে প্রায় এক দশক সময় লেগেছে। এটি মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত বেড়া প্রকল্প সংক্রান্ত লজিস্টিক অসুবিধাগুলিকে তুলে ধরে ভারত সরকারের উদ্যোগে আরও একটি জটিলতা যোগ করে।

 

উপসংহার

বেড়া দেওয়া এবং এফএমআর বাতিলের মাধ্যমে মায়ানমারের সঙ্গে নিজের সীমানা শক্তিশালী করার ভারতের সিদ্ধান্ত সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিণতি-সহ একটি জটিল পরিস্থিতি উপস্থাপন করে। নিরাপত্তাহীন সীমানা নিঃসন্দেহে অবৈধ কার্যকলাপকে সহজতর করেছে, যা এনইআর-এর আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করেছে। যাই হোক, ভারত-মায়ানমার সীমান্তে জটিল ভূগোল এবং উভয় পাশে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে অভিন্ন সাধারণ জাতিগত বন্ধন এই সিদ্ধান্তের কার্যকর বাস্তবায়নকে জটিল করে তোলে। এনইআর-এর প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের বিরোধিতা বিদ্যমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সর্বোপরি, নয়াদিল্লির পদক্ষেপগুলি এনইআর-এর মধ্যে আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা তার অ্যাক্ট ইস্ট নীতিকে বাধা দিতে পারে। মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত কৌশলের জন্য একটি সূক্ষ্ম পদ্ধতির প্রয়োজন, যা নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং অঞ্চলের জটিলতা উভয়কেই স্বীকৃতি দেয়।

 


ওফেলিয়া ইউমলেম্বাম দিল্লি ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতকোত্তর। তিনি এখন দিল্লি ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.