বাস্তব ক্ষেত্র থেকে পাওয়া তথ্য বা এমপিরিকাল ডেটা একথাই সূচিত করে যে নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর উপার্জন বাড়লে তার ফলে সরাসরি উপভোগ বাড়ে। কাজেই দীর্ঘমেয়াদে সুস্থিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য সরকারের উচিত কেইন্সিয়ান পথে এগনো।
গত তিন দশক ধরে ভারতের বৃদ্ধির (বা সাম্প্রতিক কালে তার অভাবের) কাহিনিটা হল উপভোগ–নির্ভর। এ কথাবহুবার বলা হয়েছেনীতিপ্রণেতা মহলে, বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উপভোগের কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে বাস্তব ক্ষেত্রভিত্তিক বিশ্লেষণে, এবং অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনেরঅভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের একটি সাম্প্রতিক পেপারে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রথমে ভারতীয় অর্থনীতির মন্থর হয়ে পড়া, আর তারপর ২০২০–২১–এ ঋণাত্মক বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে যথাক্রমে ব্যক্তির উপভোগজনিত ব্যয় কমতে থাকা, এবং তারপর উপভোগ চাহিদার অভাবকে (চিত্র ১)।
চিত্র ১: চূড়ান্ত উপভোগ বৃদ্ধি ও জিডিপি বৃদ্ধি (১৯৬১ থেকে ২০২০)
সাধারণ ভাবে, বিভিন্ন উদীয়মান অর্থনীতি অনেক সময়েই দেশের ভেতরে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ানোর অন্যতম উপায় হিসেবে ‘উপভোগ–নির্ভর বৃদ্ধি’র কৌশল নিয়েছে। যেমন চিন স্পষ্টই বলেছিল তাদের চতুর্দশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে মজুরি ও মাইনে বাড়িয়ে ‘উপভোগ–নির্ভর বৃদ্ধি’র কৌশল নেওয়া হয়েছিল। ‘রফতানি–নির্ভর বৃদ্ধি’র থেকে ‘উপভোগ–নির্ভর বৃদ্ধি’র এই পথ পরিবর্তন ঘটেছিল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে, যে মন্দায় ২০০৮ সালের পরে বিশেষ ভাবে আক্রান্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ, এবং তার পরিণতিতে চিনের রফতানির চাহিদা কমে গিয়েছিল। চিন বুঝতে পেরেছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থের মধ্যে এই ধরনের ঝুঁকি নিহিত থাকবেই, এবং তা থেকে উদ্ভূত বৈদেশিক ক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা চিনের উঁচু হারের বৃদ্ধির প্রয়াসকে ধরে রাখতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে বৃদ্ধির ভরবেগ ধরে রাখতে চিনকে আভ্যন্তর উপভোগ চাহিদা বাড়ানোর পথ নিতে হয়েছিল। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির চালক হিসেবে উপভোগ চাহিদার শক্তি তৈরি হয়েছিল স্বাভাবিক উপায়ে, কোনও নীতিগত হস্তক্ষেপের কারণে নয়। অতএব, যদিও অনেকে বলতে পারেন ভারতীয় অর্থনীতির আপাত পুনরুজ্জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে অতিমারির বছরে ঘোষিত আর্থিক প্যাকেজগুলির কথা (ইতিমধ্যে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এডিবি২০২১–২২ ভারতের বৃদ্ধি ১০ শতাংশ হবেবলে মনে করছে), তা হলেও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত উপভোগের শক্তির বিষয়টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া উচিত নয়। এটা বিশেষ ভাবে সত্যি মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ধারাকে অবিরত পুষ্ট করা ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে।
ঠিক এই জায়গাটাতেই এসে পড়ে অসাম্যের কাহিনী। “অসম ভারত”–এর কাহিনিটা না সহজ, না নয়াদিল্লি তাতে স্বচ্ছন্দ। এই ক্ষেত্রটাকে ভাবা হয় গবেষণার প্রথাবিরোধী ক্ষেত্র এবং নীতিনির্ধারণের আদর্শসর্বস্ব পথ হিসেবে, এবং সেই জন্যই উন্নয়নের নীতি সংক্রান্ত আলাপ–আলোচনায় তা ব্রাত্য হয়ে থাকে। সেই অর্থে অসাম্য উন্নয়নের প্রশ্নে একটা সমস্যাসঙ্কুল জায়গা হওয়া সত্ত্বেও তা নীতিনির্ধারণের মূলস্রোতে ঠাঁই পায়নি; সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে উচুঁ হারের বৃদ্ধির বিষয়টি। এইখানে যে কথাটা বুঝতে হবে তা হল ক্রমবর্ধমান অসাম্য দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধির পথে গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ১৯৫৫ সালে আমেরিকান ইকনমিক রিভিউ–এ সাইমন কুজনেট্সের যুগান্তকারী ও বিখ্যাত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, কুজনেট্স ফেনোমেনন বা কুজনেটস’ কার্ভ-এর কথা: অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও অসাম্যের সম্পর্ক উল্টো ইউ বা ঘণ্টার মতো আকারের। এর অর্থ বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়গুলিতে অর্থনৈতিক অসাম্য বাড়ে, এবং বৃদ্ধি একটা চৌকাঠ পেরনোর পর আবার তা কমতে থাকে। কুজনেট্স’ হাইপোথেসিস শুধু বাস্তবিক ক্ষেত্রের তথ্য থেকে সমর্থিতই হয়নি, একই সঙ্গে বাস্তবিক ক্ষেত্রের তথ্য ও তত্ত্বের সাহায্যে এর বিরোধিতাও করা হয়েছে, বিশেষ করে তাঁদের হাতে যাঁরা ১৯৮০–র দশকে ইস্ট এশিয়ান মিরাক্ল–এর উদাহরণ দিতেন। কিন্তু কুজনেট্স’ হাইপোথেসিস যদি সত্যি হয়, তা হলে ভারত এখনও কুজনেটস’ কার্ভ–এর ওঠার অংশটাতে রয়েছে, যা তার ‘উন্নয়নশীল দেশ’–এর তকমাটাকেই দৃঢ় করে।
তা সে যাই হোক, এতে কোনও সংশয় নেই যে ভারতে অসাম্য এখনও বাড়ছে, এবং তাওয়র্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডেটাবেসথেকে স্পষ্ট। বিষয়টি আয় ও সম্পদ, দুই ক্ষেত্রের অসমতা সম্পর্কেই সত্য। চিত্তাকর্ষক ঘটনা হল, সম্পদের অসাম্য বেড়েছে আয়ের অসাম্যের থেকে অনেক দ্রুত হারে। আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল সম্পদের অসাম্য ১৯৬১–১৯৯১–এর তুলনায় অনেক দ্রুত হারে বেড়েছে ১৯৯১–২০২০ সালে, অর্থাৎ উদারীকরণ–পরবর্তী যুগে। সারণি ১ দেখলেই এটা স্পষ্ট হবে। একেবারে উপরের ১ শতাংশ জনসংখ্যার সম্পদ ১৯৬১ সালের ১১.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯৯১ সালে হয়েছিল ১৬.১ শতাংশ; কিন্তু ২০২০ সালে ওই ১ শতাংশ হয়ে উঠেছেন ৪২.৫ শতাংশ সম্পদের মালিক। অন্য দিকে তলার ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ যেখানে ১৯৬১ সালে ছিল ১২.৩ শতাংশ, ২০২০ সালে তা কমে হয়ে গিয়েছে ২.৮ শতাংশ। এর থেকে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে যে জনসংখ্যার মধ্যে সম্পদের মালিকানা নিয়ে বিপুল ফারাক বাড়ছে।
সারণি ১: ভারতে সম্পদের বৈষম্য (মোট সম্পদে শতাংশ হারে জনসংখ্যার অংশভাগ)
Table 1: Wealth Inequality in India (share of population in total wealth in %)
অন্য দিকে আয়ের অসাম্য গোড়ার দিকে, ১৯৬১ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে, কমতে থাকলেও (সারণি ২ থেকে যা বোঝা যাচ্ছে), ১৯৯১–এর পর তা বাড়তে শুরু করল। কাজেই একথা বলা ভুল হবে না যে ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ ও উঁচু বৃদ্ধির পর্বে আয় ও সম্পদের অসাম্য বেড়েছিল।
সারণি ২: ভারতে আয়ের বৈষম্য (মোট সম্পদে শতাংশ হারে জনসংখ্যার অংশভাগ)
Table 2: Income Inequality in India (share of population in total wealth in %)
চিত্র ১ থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতির উঁচু হারের জিডিপি বৃদ্ধির সময় আর উঁচু হারের চূড়ান্ত উপভোগ বৃদ্ধির সময়টা মিলে যাচ্ছে, বিশেষ করে ১৯৯১ সালের পর থেকে। যদিও ১৯৯১ সালের পর অসাম্যও বেড়েছে, কিন্তু এবার তা আরও বাড়লে দীর্ঘতর মেয়াদে উঁচু হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অর্জন বা তা ধরে রাখার উপর খুবই খারাপ প্রভাব পড়বে। কাজেই আমাদের আয় ও সম্পদের অসাম্যের মৌলিক সংজ্ঞায় ফিরে যেতে হবে। আয় ও সম্পদ সম্পর্কিত হলেও তারা ধারণাগত ভাবে পৃথক: আয় হল একটি অর্থনৈতিক সত্তার, যেমন পরিবার, সংস্থা ইত্যাদির, হাতে আর্থিক সম্পদের প্রবাহ, যার উৎস হল একটি বছরের মজুরি, মাইনে, লাভ, বিনিয়োগ, সরকারি অর্থের সরাসরি হস্তান্তর ও অন্যান্য। অন্য দিকে সম্পদ হল একটা ভান্ডার যার মধ্যে আছে সত্তার মোট সঞ্চয় ও অতীতের থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি, এবং তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে চলতি বছরের অর্জিত সম্পত্তি ও সঞ্চয়। সেই অর্থে সম্পদ হল সত্তার মোট বিত্তের একটা মানদণ্ড—যার হিসেব কষা হয় মোট সম্পদ থেকে মোট দায় বাদ দিয়ে। সেদিক থেকে দেখলে আয় ও সম্পদ দুটোই পারিবারিক আর্থিক কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সম্পদশালী পরিবার বা অর্থনৈতিক একক তার উপভোগের সংস্থান সেই সময়েও করতে পারে যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে আয়ের উৎসগুলো শুকিয়ে যায়।
সারণি ১ অনুযায়ী শীর্ষের ১ শতাংশের সম্পদের মোট অনুপাত বেড়েছে, যদিও আয়ের অসাম্য সেই অনুপাতে বাড়েনি। এর অর্থ ঐতিহাসিক ভাবে শীর্ষ ১ শতাংশ (বা এমনকি শীর্ষ ১০ শতাংশ) যা আয় করেছে তার অনেকটাই উপভোগের পথে না গিয়ে সঞ্চয় বা সম্পত্তি করার কাজে লেগেছে। অন্য দিকে, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় করাবাস্তবিক ক্ষেত্রের সমীক্ষাদেখিয়ে দিচ্ছে যে নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীগুলির উপভোগের প্রান্তিক ইচ্ছা (বা মার্জিনাল প্রপেনসিটি টু কনজিউম) উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীগুলোর থেকে বেশি। এর অর্থ উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীগুলোর তুলনায় নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীগুলির আয় বা সম্পদ বাড়লে অর্থনীতির উপভোগের ক্ষেত্রটি সমৃদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে তা সঞ্চয় বা সম্পদ সৃষ্টিতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। অন্য ভাবে বললে, ‘বড়লোক আরও বড়লোক’ হলে সেই ঘটনা দ্রুত ও স্থায়ী বৃদ্ধির মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের বিরুদ্ধে যাবে, তা কথাটা যতই কমিউনিস্টদের মতো শোনাক না কেন।
কাজেই সরকারের প্রতিক্রিয়া হতে হবে কেইনসিয়ান ধাঁচের এবং স্বল্প মেয়াদে বাড়াতে হবে সরাসরি টাকা হস্তান্তর (অথবা সর্বজনীন বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থা করা); কিন্তু দীর্ঘতর মেয়াদে বাজারের শক্তিগুলোকে জোরদার করতে হবে। সম্প্রতি একটি নিবন্ধেমৈত্রীশ ঘটকবলেছেন সরকারের উচিত আরও বেশি সম্পদ কর বসানো এবং তা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করা, যাতে দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির উপযোগী বিস্তৃত মানব মূলধনের ভিত তৈরি করা যায়। তবে এই সব ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপকে স্থায়ী সমাধান হিসেবে ভাবা উচিত নয়। বরং সরকারের উচিত বাজারকে সক্ষম করা যাতে এমন শক্তি সৃষ্টি হয় যা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে এবং একই সঙ্গে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী মানব মূলধন সৃষ্টি হয়। এর জন্য যা প্রয়োজন তা হল উন্নয়নের প্রশ্নটিকে শুধু অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সহজসরল লেন্স দিয়ে না–দেখে উন্নয়নের সমস্যাগুলো সম্পর্কে অনেক বেশি সুসংহত দৃষ্টিভঙ্গি।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.
Dr Nilanjan Ghosh is Vice President – Development Studies at the Observer Research Foundation (ORF) in India, and is also in charge of the Foundation’s ...