অতিমারি, রাশিয়া–ইউক্রেন দ্বন্দ্ব এবং শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কী ভাবে সে দেশের পর্যটন ক্ষেত্রকে বিপন্ন করেছে?
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের ইতালীয় অভিযাত্রী মার্কো পোলো বলেছিলেন, শ্রীলঙ্কা ছিল ‘বিশ্বে তার আয়তনের সেরা দ্বীপ’। কর্মসংস্থান, বিদেশি মুদ্রা আয় ও তার পাশাপাশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপায়ে পরের পর সরকারের জন্য রাজস্বের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে দেশটির পর্যটন ক্ষেত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির অন্যতম মূল্যবান অংশে পরিণত হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় পর্যটন দেশের জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ নিয়ে আসে, এবং এটি বিদেশে কাজ–করা মানুষের পাঠানো অর্থ ও পোশাক শিল্পের পর বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারেরতৃতীয় বৃহত্তমউৎস। যাই হোক, ২০১৯–এর ইস্টার সানডে বোমা হামলা এই শিল্পের পতনের সূচনা করে, এবং তারপর শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে কোভিড–১৯ অতিমারি ও ইউক্রেন–রাশিয়া সংঘাতের দ্বিমুখী আঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে এই ক্ষেত্রের পুনরুজ্জীবন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রায়শই শ্রীলঙ্কার ‘বৃদ্ধির চালিকাশক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত দেশের পর্যটন ক্ষেত্রটি ১৯৬০–এর দশকের আগে পর্যন্ত রাস্তা, এয়ারলাইন্স বা নতুন হোটেল নির্মাণের মধ্যে দিয়ে পর্যটন পরিকাঠামোকে উন্নত করার লক্ষ্যে প্রগতিশীল পদক্ষেপ করে লক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৭০–এর দশকের শেষের দিকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির উদারীকরণের সঙ্গে পর্যটন শিল্পকে শক্তিশালী করার জন্য বড় আকারের বিনিয়োগও নিশ্চিত করা হয়েছিল। যাই হোক, ২০০৯ সালে শেষ–হওয়া শ্রীলঙ্কার ২৬ বছরের দীর্ঘ গণ-অস্থিরতা, এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের (২০০৭–০৮) ছায়া দেশটির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছিল, এবং পর্যটন শিল্পেরও অবনতি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালের পরে এই ক্ষেত্রটির দ্রুত বৃদ্ধি হয় (চিত্র ১ দেখুন), এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক কাঠামোতে ক্ষেত্রটি একটি অতি–গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে প্রমাণিত হয়।
চিত্র ১: শ্রীলঙ্কায় পর্যটকদের আগমন এবং আয় (২০০০–২০২১)
শ্রীলঙ্কার পর্যটন ক্ষেত্রটি শ্রীলঙ্কার মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানেও অবদান রাখে, এবং এই অবদান অতিমারির আঘাত না–আসা পর্যন্ত গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল (চিত্র ২ দেখুন)। ২০১৯ সালে এই ক্ষেত্রে মোট কর্মসংস্থানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪০৩,০০০৷ বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং তার পাশাপাশি অন্য বহির্দেশীয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণগুলির পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে দেশের পর্যটন ক্ষেত্র এবং সংশ্লিষ্ট অংশগুলিতে এক ধ্বংসলীলা চলেছে, যার প্রভাব শ্রীলঙ্কার বেকারত্ব পরিস্থিতির জন্য উদ্বেগজনক হতে বাধ্য৷
চিত্র ২: শ্রীলঙ্কার পর্যটন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টির খতিয়ান
সূত্র:লেখকের নিজস্ব, থুশাঙ্গা এবং পিয়াদা থেকে ডেটা (২০২১)
দেশটি ২০১৯ সালের এপ্রিলে একটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল, যখন রাজধানী কলম্বোতে ইস্টার সানডে বোমা হামলায় ২৫০ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৪২ জন শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণকারী বিদেশি নাগরিক ছিলেন। ঘটনার পর শ্রীলঙ্কা জুড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান কয়েক দিন ধরে তাদের দরজা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল। অন্য দেশগুলি তাড়াহুড়ো করে তাদের নাগরিকদের এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ভ্রমণ না–করার জন্য সতর্ক করে দিয়ে ট্র্যাভেল অ্যাডভাইসরি জারি করে। প্রচুর পরিমাণে পর্যটক দেশ থেকে প্রস্থান করেন, এবং আগের বছরের একই মাসের তুলনায় মে মাসে ভ্রমণার্থীর সংখ্যা ৭০ শতাংশের বেশি এবং জুনে ৬০ শতাংশের বেশিকমে যায়(চিত্র ৩ দেখুন)।
২০১৮ সালে পর্যটন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উপার্জন যোগ করেছিল, যা দেশটির জিডিপি–র ৫.৬ শতাংশ। কিন্তু এই অঙ্কটি ০.৮ শতাংশে নেমে আসে ২০২০ সালে, যে বছর কোভিড–১৯ অতিমারি পৃথিবীজুড়ে তাণ্ডব শুরু করে, শ্রীলঙ্কাও যার ব্যতিক্রম ছিল না (চিত্র ১ এবং ৩ দেখুন)।শ্রীলঙ্কা ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এস এল টি ডি এ)জানিয়েছে, অতিমারির কারণে ২০২০ সালে ৫০ শতাংশ রাজস্ব হ্রাস পায়, এবং পর্যটক সংখ্যাও অনেক কমে যায়। এই দুঃখের সঙ্গে যোগ হয় চিন ও ইউরোপীয় দেশগুলির পর্যটকদের অনুপস্থিতি। এরা শ্রীলঙ্কার ইতিমধ্যেই দুর্দশাগ্রস্ত পর্যটন ক্ষেত্রের বড় বাজারগুলির মধ্যে পড়ত, এবং সেই কারণে এই ঘটনা একটি বড় ধাক্কা হিসেবে এসেছিল।
চিত্র ৩: ২০১৯ ও ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার পর্যটক সংখ্যা
সূত্র:লেখকের নিজস্ব, থুশাঙ্গা এবং পিয়াদা থেকে ডেটা (২০২১)
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির জন্য বিষয়গুলিকে আরও খারাপ করে তুলেছে চলতি রাশিয়া–ইউক্রেন দ্বন্দ্ব, যা ২০২২ সালের প্রথম দিকে শুরু হয়েছে এবং শ্রীলঙ্কার পর্যটন ক্ষেত্রটিকে আরও পঙ্গু করে দিয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন, এই বছর যথাক্রমে শীর্ষ এবং তৃতীয় বৃহত্তম পর্যটন বাজার, এই জায়গাটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে প্রায় ২০,০০০ পর্যটক শ্রীলঙ্কায় ছিলেন, যা সমস্ত ভ্রমণার্থীরএক চতুর্থাংশেরও বেশি। অবশ্য এই সংখ্যাটিও ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আসা পর্যটকদের সংখ্যার ১০ শতাংশেরও কম ছিল। রাশিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড ও বেলারুশের মতো দেশগুলি থেকে ২০২২ সালের আগে পর্যটকদের প্রায়৩০শতাংশ এসেছিলেন, এবং সংঘাতের কারণে পর্যটকদের এই প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার বিপদ রয়েছে। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী দেশটি ২০১৯ সালে পর্যটন বাবদ আয় করেছিল তাৎপর্যপূর্ণ ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর তারপর দেশে যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করা গেল তার ফলে মাত্র দুই বছর পরে তা এক–পঞ্চমাংশেরও কমে নেমে গেল ।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের শাসনকালে বার বার দাবি করা হয়েছে যে পর্যটন ও রফতানি বৃদ্ধি শ্রীলঙ্কাকে উদ্বেগজনক সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। যাই হোক, পর্যটন রাজস্ব হ্রাসের ফলে পর্যাপ্ত ভাবে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার (চিত্র ৪ দেখুন) পূর্ণ হয়নি, আর সেই ভান্ডার খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে গিয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে।
চিত্র ৪: শ্রীলঙ্কার ক্রমহ্রাসমান বিদেশি মুদ্রাভান্ডারের প্রবণতা (মিলিয়ন মার্কিন ডলারে)
সূত্র:সি ই আই সি, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ শ্রীলঙ্কা
পর্যটকদের নিয়মিত আগমন নিঃসন্দেহে দুর্যোগবিধ্বস্ত দেশটির এবং তার বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া, হিংসার ধারা ও জরুরি অবস্থা জারি এমন একটি শিল্পকে বিপদে ফেলছে যা দীর্ঘদিন ধরে দেশের অগ্রগতির জন্য একটি কার্যকর অর্থনৈতিক সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে প্রমাণিত হয়েছে। সার্ভিস স্টেশনগুলিতে এই মুহূর্তে দেশের দুষ্প্রাপ্য পণ্য পেট্রলের অপেক্ষায় মোটরসাইকেল ট্যাক্সির দীর্ঘ সারির চিত্রগুলি আগামী মাসগুলিতে দেশটিতে ভ্রমণের পরিকল্পনা–করা পর্যটকদের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে৷ উপরন্তু, শ্রীলঙ্কা সরকার ৩ এপ্রিল ২০২০ সালে সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট—মেটা ও টুইটার–এর উপরনিষেধাজ্ঞা জারিকরেছে। এটি এমন একটি পদক্ষেপ যা তাঁদের অবকাশের গন্তব্য দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পর্যটকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
পর্যটন বৈদেশিক মুদ্রার আয় আকর্ষণ করে এবং আগামী বছরগুলিতে বৃদ্ধির হারের পরিপূরক হিসেবে দেশের দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার পুনরুদ্ধারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশটি যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে, সেই সময় অতীতে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির জন্য অনেক গৌরবের উৎস পর্যটন ক্ষেত্রটি তার ভাগ্যকে পুনরুজ্জীবিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
লেখক শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখিল যোশীর কাছে এই প্রবন্ধে তাঁর গবেষণা ইনপুটগুলির জন্য কৃতজ্ঞ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.
Soumya Bhowmick is a Fellow and Lead, World Economies and Sustainability at the Centre for New Economic Diplomacy (CNED) at Observer Research Foundation (ORF). He ...