আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতে ইলিশ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সে দেশ থেকে আর ভারতে ইলিশ রফতানি করা হবে না। রফতানিকারকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, সরকার ৩০০০ টন পরিমাণ এই মূল্যবান মাছ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে রফতানি করার অনুমতি দিয়েছে। ইলিশ মাছ বিশ্ব জুড়ে বাঙালিদের জন্য একটি উপাদেয় খাবার এবং বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে তা খাওয়া হয়। বিভিন্ন ইলিশ মাছের উৎসের মধ্যে বাংলাদেশের পদ্মা নদীই সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্নজাত ইলিশ উৎপাদন করে। নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার বিষয়ে ঢাকার সিদ্ধান্ত বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে ভারতের বাঙালিদের মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত করেছিল। স্থানীয় মাছ বিক্রেতারা উৎসবের চাহিদা মেটাতে নিজেদের সীমিত হিমায়িত সরবরাহ প্রায় দ্বিগুণ এবং প্রাক্-নিষেধাজ্ঞার চেয়েও তিনগুণ দামে বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বের ত্রিপুরায় মাছ পাচার হওয়ার খবরও পাওয়া গিয়েছে। ত্রিপুরা থেকে সেই ইলিশ মাছ কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার বিষয়ে ঢাকার সিদ্ধান্ত বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে ভারতের বাঙালিদের মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত করেছিল।
ইলিশ রফতানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তটি মাছের দাম কমাতে এবং অবৈধ বাণিজ্য হ্রাস করার জন্য গৃহীত হলেও, তা আদতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অর্থও বহন করে, যা বর্তমানে একটি জটিল সন্ধিক্ষণে রয়েছে।
‘ইলিশ কূটনীতি’র গল্প
বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ইলিশ উৎপাদক, বিশ্বব্যাপী ইলিশ মাছ ধরার প্রায় ৭৫ শতাংশের জন্য দায়বদ্ধ এবং এই শিল্প দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে। ভারত মাত্র ৫ শতাংশ ইলিশ উত্পাদন করে। বাংলাদেশ থেকে ইলিশের বৃহত্তম আমদানিকারক ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষই আমদানি করা ইলিশ ভোগ করেন। উৎপাদনের এই অসামঞ্জস্য ইলিশকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কূটনীতির এক অনন্য উপকরণে পরিণত করেছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে মাইলফলকসম গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের ঠিক আগে ইলিশ উপহার দিয়েছিলেন। তারপর থেকে হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ইলিশ উপহার দিয়েছেন এবং ২০১৭ সালে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকেও দীর্ঘস্থায়ী তিস্তা নদীর জলবণ্টন বিরোধ সমাধানের জন্য একটি কূটনৈতিক উপঢৌকন স্বরূপ ইলিশ পাঠিয়েছিলেন।
হাসিনা দুর্গাপুজোর আগে এই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে ‘ইলিশ কূটনীতি’ পুনরুজ্জীবিত করার সদিচ্ছা হিসেবে ভারতকে এক হাজার টন মাছ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
যাই হোক, একই বিরোধের জের ধরে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ভারতে ইলিশ মাছ রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। সাত বছর পর ২০১৯ সালে হাসিনা দুর্গাপুজোর আগে এই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে ‘ইলিশ কূটনীতি’ পুনরুজ্জীবিত করার সদিচ্ছা হিসেবে ভারতকে এক হাজার টন মাছ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অবশ্য কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় ভারতে ইলিশের রফতানি অনেকটাই কম হয়েছিল। ২০২০ সালে ১২০০ টন ইলিশ এবং ২০২১ ও ২০২২ সালে ১৩০০ টন ইলিশ আমদানি করেছিল ভারত। অতিমারি সংক্রান্ত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পরে এই বাণিজ্যে গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে হাসিনা ‘দুর্গাপুজো উপলক্ষে ৭৯টি সংস্থার প্রত্যেককে ৫০ টন করে অর্থাৎ মোট প্রায় ৪০০০ টন ইলিশ রফতানি করার অনুমতি দিয়েছিলেন।’ এ বছর অবশ্য সেই ঐতিহ্যে ছেদ পড়ল।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ
উৎসবের মাসগুলিতে ইলিশ রফতানি অব্যাহত রাখার জন্য কলকাতা ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রকের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘আগের সরকার দুর্গাপুজোর উৎসবের সময় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিত। তারা এটাকে উপহার বলে মনে করত। আমি মনে করি না যে, এ বার আমাদের এই ধরনের উপহার দেওয়ার দরকার আছে বলে। যদি আমরা তা করি এবং ভারতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ রফতানি করার অনুমতি দেওয়া হয়, তা হলে আমাদের মানুষরাই মাছ খেতে পাবে না।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার সিদ্ধান্তকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে জনগণের আবেগের সঙ্গে আরও বেশি করে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলার একটি পদক্ষেপ হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। জনগণের বিক্ষোভের কারণে শেখ হাসিনা ৫ অগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন। বর্তমানে হাসিনা সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভারতে তাঁর অব্যাহত আশ্রয়ের কারণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিরোধী মনোভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি মর্যাদা নিয়ে বিতর্ক চলছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার নিজের কর্তৃত্বের জন্য জনসমর্থনের উপর আরও বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যাই হোক, নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত বিভিন্ন কারণে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
বর্তমানে হাসিনা সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভারতে তাঁর অব্যাহত আশ্রয়ের কারণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিরোধী মনোভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
১) নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সত্ত্বেও সরবরাহ ঘাটতি, মাছ ধরার উচ্চ খরচ এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে ইলিশের অভ্যন্তরীণ দাম গত বছরের তুলনায় আরও বেশি। এ দিকে আবার ভারতীয় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ইলিশ রফতানিকারকরা।
২) ইলিশ রফতানি সীমিত করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত পরোক্ষ ভাবে সীমান্তের অন্য পারে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের উৎসবকে প্রভাবিত করেছে। এটি বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় মহম্মদ ইউনুসের প্রতিশ্রুতিকে সন্দেহের মুখে ফেলে, বিশেষ করে সেই সংবেদনশীল সময়ে যখন রাজনৈতিক উত্তরণের পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন হিংসা ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছিলেন।
৩) এই নিষেধাজ্ঞা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সদিচ্ছাকে ভঙ্গুর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই সঙ্কটকালে আরও ক্ষুণ্ণ করবে। আখতার যদিও মুখের কথায় বলেছিলেন যে, নিষেধাজ্ঞার ফলে সদিচ্ছা নষ্ট হবে না এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই সদিচ্ছা বজায় থাকবে। তবে এটি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় বাঙালিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।
ফলস্বরূপ, এই বাধাগুলির কারণে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যাই হোক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি নোটিশ প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হবে। এর জবাবে আখতার এক দিকে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের দায়ভার চাপিয়েছেন এবং অন্য দিকে বলেছেন যে, রফতানিকারকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং ‘দুর্গাপুজো উপলক্ষে নির্দিষ্ট শর্তাবলি পূরণ করার জন্য এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।’ বাণিজ্য মন্ত্রকের উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ মানুষের প্রতিবাদকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন যে, ভারতের জন্য বরাদ্দকৃত ৩০০০ টনের চালান আসলে চাঁদপুরে (বাংলাদেশ) এক দিনে যত মাছ ধরা হয়, তারই সমান। সুতরাং, এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দরুন অভ্যন্তরীণ ভাবে মাছের দাম তো বাড়বেই না, বরং বৈদেশিক আয় সুনিশ্চিত করা যাবে এবং অবৈধ বাণিজ্য হ্রাস পাবে। আহমেদের যুক্তি আখতারের ইলিশ রফতানি নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা সংক্রান্ত আগেকার মন্তব্যের স্পষ্ট বিরোধী, যা অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসঙ্গতিকেই দর্শায়। এই সব কিছুই প্রতিফলিত করে যে, কী ভাবে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনার উপর ভূ-অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তাগুলি প্রভাব ফেলেছে।
আহমেদের যুক্তি আখতারের ইলিশ রফতানি নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা সংক্রান্ত আগেকার মন্তব্যের স্পষ্ট বিরোধী, যা অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসঙ্গতিকেই দর্শায়।
কূটনৈতিক টানাপড়েন
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে ভারত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকা ভারতে ইলিশ রফতানি করে যথেষ্ট রাজস্ব আয় করে, যা শুধু বাজারই নয়, জেলে এবং সমগ্র মৎস্য মূল্যশৃঙ্খলকেও উপকৃত করে। ইলিশের উপর ৩৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমানোর আলোচনা উভয় দেশের জন্য অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করতে পারে এবং আরও শক্তিশালী ও বৈচিত্রপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম সীমান্ত অর্থাৎ ৪০৯৬.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের কারণে বাণিজ্যের ঊর্ধ্বে উঠেও অভিন্ন সম্পদ, পারিবারিক বন্ধন এবং পারস্পরিক আন্তঃনির্ভরতার কারণে বিস্তৃত। দুই দেশের সম্পর্ক চিকিৎসা পর্যটনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও বিস্তৃত। বর্তমান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও একটি কার্যকর অংশীদারিত্ব বজায় রাখা অপরিহার্য। যেহেতু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করছে, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রয়োজনের পাশাপাশি জনগণের আবেগকে চালনা করা আসলে কূটনৈতিক দক্ষতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে। ইলিশ কূটনীতির ঐতিহ্য রক্ষা করে উভয় দেশ একটি শক্তিশালী আরও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
সোহিনী বোস অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.